হাকিকুল ইসলাম খোকন,
দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এলেন তিনি ব্রুকলীনের প্যারামাউন্ড থিয়েটারের মঞ্চে, বাম দিক থেকে। হালকা শ্মশ্রম্নমন্ডিত মুখে সেই চিরপরিচিত হাসি। হাত তুলে স্বাগত জানালেন থিয়েটারে উপস্থিত সমর্থকদের। এবং বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা কোটি কোটি মানুষকে। হ্যাঁ নিউইয়র্ক ও আমেরিকা ছাড়িয়ে পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য মানুষের দৃষ্টি তখন ইতিহাস সৃষ্টি করে একজন ইমিগ্রান্টের নিউইয়র্কের মত মেগা সিটির মেয়র নির্বাচিত হওয়া তরুণ জোহরান মামদানির দিকে। তিনি বিজয় ভাষণ দেবেন। কণ্ঠে তার দৃঢ়তা, ভাষায় দ্ব্যর্থহীনতা, চোখজুড়ে সীমাহীন স্বপ্ন। ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছড়িয়ে দিলেন একটির পর একটি আশাবাদ। বললেন, এই সিটিতে আজকের দিনটি যেন গতকালের চেয়ে সুন্দর হয়। বললেন, পুরনো যুগের অবসান হয়েছে। এখন নতুন যুগ। বললেন, আজ সেই রাজনীতির মৃত্যু হলো, যে রাজনীতি মানুষের জন্য নয়। আশা ও স্বপ্ন জাগিয়ে তিনি যে ২১ মিনিটের ভাষণ দিলেন, তা আসলে নিউইয়র্ক সিটিতে নতুন যুগের সূচনা করল। নানা কারণে অনেকে পছন্দ বা অপছন্দ করলেও ভাষণের ভাষ্য এবং বাচনভঙ্গি ও ডেলিভারির কারণে তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো সমালোচনা হয়নি।
গত মংগলবার,৪ নভেম্বর নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস তৈরি হয়, তা বিশ্ব রাজনীতির জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ বললে খুব বেশি বলা হবে না। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে কীভাবে বিজয় অর্জন করতে হয়, সারা বিশ্বের রাজনীতিকদের জন্য সেই ‘সহজপাঠ’ তৈরি করেছেন জোহরান মামদানি। তারা শিক্ষা নিতে পারেন জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা কৌশল থেকে।খবর আইবিএননিউজ ।
শুধু নির্বাচনে জেতাই যে একজন নেতার মূল লক্ষ্য হতে পারে না তা পরিষ্কার বোঝা গেল বিজয়মঞ্চে বিজয়ীর ‘দুনিয়া কাঁপানো’ ভাষণে। প্রায় ২১ মিনিটের সেই ভাষণে জোহরান মামদানি প্রমাণ করলেন, ‘সততা শুধু সর্বোত্তম নয়, একমাত্র পন্থা’, যা কোনো রাজনীতিবিদের কাছে আজকাল কেউ প্রত্যাশা করেন না। কেননা, সারা বিশ্বে সাধারণ দৃশ্য হলো, রাজনীতিবিদরা জনকল্যাণের কথা বলে নির্বাচনে জয়ী হলেও দিন শেষে তারা নিজেদেরই ভাগ্য—উন্নয়নে ব্যস্ত থাকেন।
বিজয়ের মঞ্চে সেই ‘দীর্ঘ ঐতিহ্য’ ভাঙার প্রতিশ্রুতিই দিলেন জোহরান মামদানি। বললেন, ‘আজ সেই রাজনীতির মৃত্যু হলো, যে রাজনীতি বেশিরভাগ মানুষকে ত্যাগ করে শুধুমাত্র নিজেদের মানুষকে গ্রহণ করে।’ স্বর আরও একধাপ চড়িয়ে বললেন, ‘আমরা নতুন যুগের নেতৃত্ব শুরু করতে যাচ্ছি। আমরা আপনাদের জন্য লড়াই করবো। কারণ, আমরা আপনাদেরই লোক।’
রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের নিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে জনমনে যে ক্ষোভ—হতাশা ও ধিক্কার জমে আছে, তা দূর করে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার আহ্বানের পাশাপাশি দিকনির্দেশনাও দিলেন সবে ৩৪—এ পা দেওয়া এই নেতা।
জনতার ভোটে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি জানালেন— এখন সময় এসেছে তার নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার। ভক্তদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘প্রতিদিন সকালে একটি কাজের জন্য ঘুম থেকে উঠবো। সেই কাজটি হচ্ছে, এই সিটিতে আপনার আজকের দিনটি যেন গতকালের চেয়ে সুন্দর হয়।’
এই তরুণ নেতা সবার মনে শুধু আশাই জাগিয়ে দেননি সেই আশা বাস্তবায়নের পথও দেখিয়েছেন তিনি। কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা দিয়ে জোহরান মামদানি বললেন—আমলাতন্ত্রের কারণে যে অর্থ নষ্ট হয় তা কমানো হবে।
আরও বললেন, পুরনো যুগের অবসান হয়েছে। এখন নতুন যুগ। জানালেন— মেয়রের কার্যালয় সবার জন্য উন্মুক্ত।
তার ভাষ্য, এই নতুন যুগে থাকবে জনসাধারণের জন্য সিটি প্রশাসনের সাহসী উদ্যোগ। এই নতুন যুগে ‘দুঃখিত’ বলে কোনো নেতার পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি মেনে বিজয়ের মঞ্চে জোরালো কণ্ঠে তিনি ঘোষণা দিলেন— রেন্ট কন্ট্রোলড বাড়িভাড়া বাড়ছে না। বাসগুলো বিনা ভাড়ায় যাত্রী বহন করবে। অভিভাবকরা যাতে তাদের সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজেদের কর্মস্থলে সময়মতো আসতে পারেন তার ব্যবস্থা হবে। বললেন, পুরো সিটিতে চাইল্ড হেলথ কেয়ার বিনামূল্যে দেওয়া হবে।
অপরাধ কমানোর কথা বলেছিলেন তিনি। সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন ন্যায়বিচারের কথাও। সবাইকে নাগরিক সুবিধা দিয়ে অপরাধ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন। গৃহহীনতা ও মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা সমাধানে নতুন বিভাগ খোলারও ঘোষণা দিলেন নবনির্বাচিত মেয়র। একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো থেকে মুক্ত থাকার অনুরোধ করেছেন নতুন প্রজন্মের এই নেতা।
তার ভাষ্য— ‘সুস্পষ্ট করে বলছি—আশা বেঁচে আছে’। এই আশায় বুক বেঁধে প্রতিদিন এক লাখ স্বেচ্ছাসেবক দিনের পর দিন কাজ করেছেন জোহরান মামদানিকে জেতাতে। তারা আশায় বুক বেঁধে ভোট দিয়েছেন তাকে বিজয়ী করতে। তারা সবাই মিলে আশাকে লালন করেছেন নতুন দিনের জন্য। তারা আশা করেছেন হতাশার বিরুদ্ধে। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করার আশা নিয়ে কাজ করেছেন। আজ তারাই জয়ী হয়েছেন— বললেন জোহরান মামদানি।
এই ইতিহাস—গড়া মেয়র—ইলেক্টের বিশ্বাস— বিদ্যমান রাজনৈতিক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে আলো দেখাবে নিউইয়র্ক। তিনি চান—জাতি—গোষ্ঠী, ধর্ম—বর্ণ নির্বিশেষে সবার পাশে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত দেখাবে এই সিটি। সব শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়াবে সিটি প্রশাসন। সবার হাতে কম দামে নিত্যপণ্য তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
নিউইয়র্কের সংখ্যালঘু ইহুদি সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি অপর সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশেও দাঁড়ানোর কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন ‘সবার মেয়র’ জোহরান মামদানি। এই নতুন যুগে এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি দেখাবে। তিনি বললেন, ‘এমন বড় কোনো সমস্যা নেই যা সরকার সমাধান করতে পারে না। আবার ছোট বলে কোনো সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া হবে না।’
এই লেনদেনের দুনিয়ায় জোহরান মামদানি এমন সিটি প্রশাসন গড়তে চান যে প্রশাসন সব নাগরিককে সহযোগিতা করবে।
এতদিন যারা অর্থ—ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে চলেছেন তাদের জন্য বার্তা ছিল— এখন থেকে আইন সবার জন্য সমান।
‘আমরা সবাই মিলে পরিবর্তনের দুয়ার খুলে দেবো। এই নতুন যুগকে সাহসের সঙ্গে বরণ করবো। ভয়ে পালানোর পথ খুঁজবো না।’ তিনি অভিজাততন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদীদের সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আশাদীপ্ত স্বরে বলেন, ‘আমরা শুধু ট্রাম্পকেই থামিয়ে দিইনি। আগামীতে যারা আসবেন তাদেরকেও থামিয়ে দেওয়া হবে।’
নিজ দেশের মহাক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে তার ছিল উচ্চকণ্ঠ। জোরালো ভাষায় বললেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প, জানি আপনি আমাদের দেখছেন। আপনার জন্য চারটি শব্দ রেখেছি— ‘টার্ন দ্য ভলিউম আপ’—শব্দ আরেকটু বাড়িয়ে দিন, যাতে সব কথা পরিষ্কার শুনতে পান।’
জোহরান মামদানি ইমিগ্রান্টবিরোধী ট্রাম্পকে আরও কঠোর বার্তা দিয়ে বললেন, ‘নিউইয়র্ক ইমিগ্রান্টদের শহর। এই শহর ইমিগ্রান্টরা গড়ে তুলেছেন। এই শহর ইমিগ্রান্টদেও শক্তিতে বলীয়ান। তাই এই শহরের নেতৃত্ব দেবেন একজন ইমিগ্রান্ট।’
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এখন একজনকে ধরে নিয়ে গেলে সবাইকে ধরে নিয়ে যেতে হবে।
প্রবল জনসমর্থনে উজ্জীবিত মামদানি জানেন যে তাকে ঘিরে জনতার প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। তাই উদ্দীপ্ত জনতাকে বললেন, ‘আমরা সেই প্রত্যাশা পূরণ করবো।’
তিনি নিশ্চিত করলেন, মধুর মধুর কথা বলে মানুষের মন জয় করা হয়েছে, তা ঠিক। কিন্তু, মেয়রের আসনে বসার পর সেসব কথা উবে যাবে না। প্রচারণার দিনগুলোয় তিনি যে বলিষ্ঠতা দেখিয়েছিলেন ক্ষমতায় বসে তা হারিয়ে ফেলবেন না।
নিজের যোগ্যতা নিয়ে তার অস্পষ্টতা নেই। তাই দীপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘জানি আমি তরুণ। আমি মুসলিম। আমি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট। এসবের জন্য আমি লজ্জিত নই।’
তিনি বারবার সুস্পষ্ট ভাষায় শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষার কথা বলেছেন। তাদের বারবার আশ্বস্ত করে বলেছেন, কোনো প্রতিশ্রুতিই বাতাসে মিলিয়ে যাবে না।
সকালে নিউইয়র্কবাসী দৈনিক কাগজে পাবেন তার সরকারের সাফল্যের সংবাদ, কলঙ্কের সংবাদ নয়।
ব্রুকলীনের সেই ঐতিহাসিক ২১ মিনিটের ভাষণের শেষ বাক্য বিশ্ববাসী শুনলেন, ‘আজ যেসব কথা আমরা সবাই মিলে বলছি, যে স্বপ্ন সবাই মিলে দেখেছি, তার বাস্তবায়ন সবাই মিলেই করবো।’
Leave a Reply