মোঃ আরিফুল ইসলাম মুরাদ সাংবাদিক নেএকোনা জেলা প্রতিনিধিঃ আমার বড় ভাই গোলাম রব্বানী চৌধুরী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আজীবন একজন সংগ্রামী মানুষ। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি আমাদের বিশাল গোষ্টির চাচাত ফুফাত ভাই ও গ্রামের তরুণদের নিয়ে নিজস্ব বাহিনী গঠন করে শুরু করে দিয়েছিলেন যুদ্ধ। তখন পারিবারিক বন্দুক আর সরকি-লাঠি সম্বল করেই পাকিস্তান বাহিনীর দুটি ছোট ক্যাম্প, ‘ধানকোনা’ ও ‘ফৈজন পুর’ দখল করেন। ক্যাম্প দু’টি থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ, ওয়ারলেস সেটসহ প্রচুর যুদ্ধ সামগ্রী জব্দ করেন।
নেত্রকোনা জেলার হাওর অঞ্চলের একটি বড় অংশ মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি, সা্ল্লা, দিরাই, জামালগঞ্জ এই পাঁচ থানার মধ্যবর্তী এক বিশাল এলাকা নিজস্ব উদ্যোগে মুক্ত করে রাখেন নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়ে অঞ্চলে ফেরার আগ পর্যন্ত। দু’একবার আক্রমণ করা ছাড়া এই এলাকায় কখনও পাক-বাহিনী অবস্থান নিতে পারেনি।
ঢাকার সাথে বৃহত্তর সিলেটের প্রধান যোগাযোগ ছিল তখন নদীপথ। এই নদীপথের সুরমা নদীর দুই পাড়ে খালিয়াজুরি থেকে সাচনা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে তিনি স্থানীয় জনগণকে সংগঠিত করে। বন্ধ করে দিয়েছিলেন পাকিস্তান বাহিনীর নৌ- যোগাযোগ ব্যবস্থা।
আগস্টের শেষের দিকে গাগলাজুর আর বরান্তর এর মাঝখানে সুরমা নদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ৫শ’ টন ধারনক্ষমতাসম্পন্ন কার্গো ভেসেল দখল করেন। এই জাহাজ দুটি থেকে উদ্ধার হয় পাকিস্তানিদের রেশনের বিপুল পরিমাণ মালামাল। প্রায় সাড়ে তিনশ নৌকা বোঝাই করে মহেশখলা মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য সব মালামাল পাঠান তিনি।
এরপর চলে যান ট্রেনিং নিতে ভারতের তান্ডুয়ায়। মহেশখলা ক্যাম্পে রেখে যান তাঁর অন্তসত্তা স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান। তার সদ্য প্রসুত শিশু তখন ক্যাম্পে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করে।
যুদ্ধের পর দুইবার এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। কথিত আছে চেয়ারম্যান থাকাকালীন ১০ বছর সময়ে তাঁর ইউনিয়নে কোনদিন পুলিশ যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। বছরে এক দুইটি বিরল মামলা ছাড়া কোন কেস ফাইল হয়নি থানায়।
বর্ষায় হাওর অঞ্চলের ৮০ ভাগ মানুষই থাকে মূলতঃ মৎস্যজীবী। তাদের জন্য একটি অভিশাপ ছিল ব্রিটিশদের করা ‘ভাসান মহাল ইজারা’ আইন। ব্রিটিশ আমল থেকে অনেক জেলে সমিতি, কমিউনিস্ট সংগঠনগুলো এই আইনের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন করেছে। গোলাম রব্বানী চৌধুরী চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় মোহনগঞ্জ খালিয়াজুরির জেলেদের নিয়ে আবার এই ‘ভাসান মহাল ইজারা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলন বন্ধ করতে যাওয়া পুলিশ বাহিনীর গুলির মুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলে পুরো বাহিনীকে তিনি আটক করে রাখেন দীর্ঘ সময়। এ নিয়ে মামলা হলে মোহনগঞ্জ খালিয়াজু্রি হাওর অঞ্চলের ১০ হাজারের অধিক জেলে কৃষক নিয়ে মিছিল করে জেলার ডিসি কার্যালয় অবরোধ করেন। এ সময়ই সরকার বাধ্য হয় এই অভিশপ্ত আইন বিলুপ্ত করতে। হাওরের মুক্ত জলাশয়ে জেলেসহ সকল হাওরবাসী ফিরে পায় স্বধীন ভাবে মাছ ধরার অধিকার।
তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে বীরত্বের কাহিনী।
১৯৭১-এ কলকাতা থেকে একটি বেশ বড় ছবি কিনেছিলেন বঙ্গবন্ধুর। ‘৭৫এর পর ছবিটির নীচে দুই লাইন কবিতা লিখে ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। লাইন দু’টি ছিল
– “আমরা যুদ্ধ করে গুলি খেয়ে বক্ষে
স্বাধীনতা এনে দিই দালালের পক্ষে”
আজ এই দিনে তিনি চিরদিনের জন্য মিশে গেছেন জন্মভূমির প্রিয় মাটির সাথে।
Leave a Reply