মোঃ আবু মুসা আসারি
সিনিয়র রিপোর্টার
লড়াইয়ের অভিঘাত কতটা ভয়ানক হইতে পারে; দাঙ্গা ও সংঘাত কীভাবে পৃথিবীর মানচিত্রের দৃশ্যপট পাল্টাইয়া দিতে সক্ষম এবং সর্বোপরি ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব’ মানুষের জীবনের গুরুত্ব কতটা তলানিতে নামাইয়া আনিতে পারে, তাহা আমরা চোখের সামনে দেখিতেছি ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে। মৃত্যুপুরীতে পরিণত এই জনপদ আমাদের স্পষ্টভাবে দেখাইয়া দিতেছে, আধুনিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘প্রতি বর্গমাইল ভূমি কায়েম রাখিবার জন্য’ ঠিক কত প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়!
জাতিসংঘ সদ্য জানিয়াছে, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় প্রতিদিন গড়ে ১০০ শিশু হতাহত হইতেছে। গাজার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘাতে এ পর্যন্ত অন্তত ৫০ হাজার ৬০৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৬৩ জন আহত হইয়াছে। অনুমান করা যাইতেছে, প্রকৃত সংখ্যা ইহার চেয়েও অধিক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হতাহতদের মধ্যে সিংহভাগই নারী ও শিশু। ধ্বংসস্তূপের নীচে এখনও অসংখ্য নারী-শিশু নিখোঁজ রহিয়াছে, এমনটি জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
গাজার শিশুদের সঙ্গে যাহা ঘটিতেছে, তাহা যেন সৃষ্টিকর্তার সাথেই প্রতারণার তুল্য। নিষ্পাপ, কোমল হৃদয়ের শিশুদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ও স্নেহশীল হইবার নির্দেশ পৃথিবীর প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলিতে কঠোরভাবে প্রদান করা হইয়াছে; কিন্তু বাস্তবে কে শুনিতেছে সেই আহ্বান? বিশ্বজুড়ে শিশুদের ‘ফেরেশতার মতো’ বলিয়া সম্বোধন করা হইলেও, সেই স্বর্গীয় শিশুদের সাথেই আমরা কেমন অমানবিক আচরণ করিতেছি! আমরা কি ভুলিয়া গিয়াছি, ‘আল্লাহর প্রতিনিধি’ নামে বিবেচিত শিশুদের প্রতি প্রতিটি নিষ্ঠুর আচরণ সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টির বাইরে নয়? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন, “প্রতিটি শিশু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এই বার্তা লইয়া যে, স্রষ্টা এখনও মানবজাতির ওপর আস্থা হারান নাই”; কিন্তু গাজার শিশুদের প্রতি চলমান অমানবিকতা দেখিয়া প্রশ্ন উঠিতেছে—স্রষ্টা আমাদের উপর আর কতটা আস্থাশীল থাকিবেন?
বিভিন্ন অনুসন্ধানে উঠে আসিতেছে, গাজার হাজার হাজার শিশু পরিবারহীন হইয়া পড়িয়াছে। যারা আহত হইয়াছে, তাহারাও নিরাপদ নয়। দিন-রাত বোমা, গুলি আর মিসাইলের শব্দে তাহাদের মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকিয়াছে, তাহা পর্যবেক্ষণে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানাইতেছেন—এইসব শিশুদের ভবিষ্যৎ কার্যত অন্ধকারে ঢাকা। ইহা শুধু গাজার নয়, গোটা মানবজাতির জন্যই অশুভ সংকেত। নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি আছে—‘সমাজ যেভাবে শিশুদের সঙ্গে আচরণ করে, সেখানেই সমাজের প্রকৃত রূপ প্রতিফলিত হয়’; সেই বিবেচনায় গাজা প্রসঙ্গে আমরা আসলে কী বলিব? গাজার শিশুদের সামনে আমরা কী জবাব দিব? অথচ সমাজকর্মী হেনরি ওয়ার্ড যেমন বলিয়াছেন—‘শিশুরা হইতেছে এমন কিছু হাত, যাহার দ্বারা আমরা স্বর্গ ছুঁইতে পারি।’ সেই ‘স্বর্গের হাত’গুলিকেই রক্ষা করিতে আমরা কি ব্যর্থ হইতেছি?
লড়াই কোনোদিনই মঙ্গল বয়ে আনে না—এই বাস্তবতা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করিতে হইবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হাঙ্গেরিয়ান সেনা পল কার্ন যুদ্ধে মাথায় গুলিবিদ্ধ হইয়াও প্রাণে বাঁচিয়াছিলেন, কিন্তু জীবনের বাকি চল্লিশ বছর একটিবারের জন্যও ঘুমাইতে পারেন নাই—যেখানে একজন মানুষ গড়পরতায় ১১ দিন নির্ঘুম থাকিলে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ মানুষের শান্তি, ঘুম ও স্বস্তি সব কাড়িয়া নেয়। অতএব, আমরা যদি শান্তির আবেশে ঘুমাইতে চাই, তবে আমাদের ভাবিয়া দেখা উচিত, যুদ্ধ কি তাহা সম্ভব করিয়া তোলে?
মার্কিন কবি কার্ল স্যান্ডবার্গ বলিয়াছেন—“একটি শিশু হইল স্রষ্টার সেই বার্তা, যে বার্তায় বলা হয় বিশ্বকে এখনো সামনের দিকে এগোতে হইবে।” সুতরাং, স্রষ্টা-প্রেরিত গাজার শিশুদের প্রতি চলমান অমানবিকতার প্রেক্ষিতে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা হইতে পারে—বিশ্ব কি এই দিকহীন সহিংসতা নিয়াই সামনে অগ্রসর হইবে? গাজার শিশুদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব নীরব কেন? এই মৌনতা ভাঙিবার সময় কি এখনও আসেনি?
Leave a Reply