এম রাসেল সরকার:
রাজধানীর মুগদা এলাকায় মাদক ব্যবসা এবং কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ঘটনায় মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা হামলা চালিয়েছে এবং মাদকবিরোধী অভিযানে পুলিশের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
মুগদা মানিকনগর মান্ডা এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে মাদক কেনাবেচার প্রকাশ্যে হাট বসে, যেখানে মূলত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদক সেবন ও বিক্রি করেন। এই এলাকার ময়লা বস্তির মতো কিছু স্থানে নিয়মিত মাদক ও ছিনতাইবিরোধী অভিযান চালায় পুলিশ। এসব অভিযানে পুলিশ কর্মকর্তারা হামলার শিকার হয়।
কয়েকদিন আগে মুগদা মদিনাবাগ এলাকার ময়লা বস্তিতে মাদক ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হন মুগদা থানার এসআই রাসেল মিয়া। এ ঘটনায় পুলিশ ১০ জনকে গ্রেপ্তারও করেন।
মুগদা এলাকায় ‘চাঁন-জাদু গ্রুপ’ এবং ‘টাইগার ইমন’ গ্রুপের মতো বেশ কিছু কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে মাদক বেচাকেনায় বাধা দেওয়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দেশীয় অস্ত্র হাতে এক পরিবারের ওপর হামলাও চালায়। এসব গ্যাং ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক সেবন ও বিক্রি, সহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে এসব মাদক ব্যবসায়ী ও গ্যাংয়ের সদস্যরা অবাধে অপরাধ করে যাচ্ছে। একসময় ছাত্রলীগের ক্যাডার শরিফ নামের এক ব্যক্তি কিশোর গ্যাং প্রতিষ্ঠিত করে এবং মাদক ব্যবসা চালাতেন। এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় আড্ডা দিয়ে পথচারীদের, বিশেষ করে নারীদের উত্ত্যক্ত করে। তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলে হামলার শিকার হওয়ার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেন না।
অভিযোগ রয়েছে রাজধানীর মুগদা এলাকা যেন এক মাদকের স্বর্গরাজ্যের পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই এলাকার প্রত্যেকটি অলিগলিতে প্রশাসনের নাকের ডগায় আবাদে চলছে মরন নেশা মাদক, বিশেষ করে মুগদা স্টেডিয়ামের পিছনে ও সামনের গেইটে প্রতিনিয়ত মাদক বেচাকেনার জমজমাট বাণিজ্য এছাড়াও মানিকনগর বিশ্বরোড ও বালুর মাঠ সহ মানিকনগর বসুন্ধরায়।
মান্ডা প্রথম গুলি মোশারফ মিয়ার বাড়ির নিচে, মান্ডা মুড়িয়ালি গলি, মুগদা মদিনাবাগ এসব এলাকার অলিতে গলিতে প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব মরন নেশা মাদক ব্যবসার মহোৎসব চলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মানিকনগর বিশ্বরোড ও মুগদা স্টেডিয়ামের সমনে-পিছনের অংশে জনসম্মুখে প্রতিনিয়ত যেন মরণ নেশা ইয়াবা, গাজা, হিরোইনের হাট বসে, এসব মাদক ব্যবসায়ীদের আতঙ্কে কেউ দেখেও যেন না দেখার চেষ্টা করে চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মুগদা মদিনাবাগের ময়লা-ডিপু এলাকাতেও পরিচিত মাদকের আখড়া হিসেবে এখানেও সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দীর্ঘদিন যাবত সকল রকমের মাদক বিক্রি চলছে। মানিকনগর কুমিল্লা পট্টির মাথায় গ্যরেজে এবং মানিকনগর বিশ্বরোড ও বালুর মাঠের অবস্থা খুবই ভয়ংকর। মান্ডা প্রথম গলি, মুড়িয়ালীর গলি, মান্ডা খালপাড়, মুগদা বড় বাজারের আশপাশে, গার্মেন্টস গলি, দক্ষিণ মুগদা মসজিদ গলি প্রত্যেকটি গলি জুড়েই চলছে মাদকের হাট বাজার।
স্থানীয়দের অভিযোগ-প্রশাসন সব জেনেও রহস্য জনক নীরবতায় আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে যাচ্ছে। এবং এসব অবৈধ মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু নেতাকর্মী।
আরও অভিযোগ রয়েছে ভয়ংকর মাদকের পাশাপাশি মুগদা মান্ডা মানিকনগর এলাকায় প্রায় দু-ডজন জুয়া ও মাদকের স্পট রয়েছে। প্রতিদিনই এখানে লক্ষ লক্ষ টাকার জুয়ার আসর বসে এবং দিন-দুপুরে দূর-দূরান্ত থেকে জুয়াড়িরা ভিড় জমায়। জুয়া ও মাদক আসরের কারণে তরুণ সমাজ ধ্বংসের পথে, অনেক উঠতি যুবক ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। প্রায় প্রতিরাতেই এসব আসরকে কেন্দ্র করে মারা-মারি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
সূত্রে জানা যায়, মাদক ও জুয়া আসর থেকে প্রশাসন ও প্রভাবশালী নেতাদের কে মোটা অংকের টাকা দিয়ে পরিচালনা করা হয়। মাদক জুয়া সিন্ডিকেট সদস্য সরাসরি স্বীকার করে তারা বলেন আমরা থানাকে টাকা দেই, দলের প্রোগ্রামে পোলাপাইন সরবরাহ করি, তাই আমাদের ব্যবসা কেউ বন্ধ করতে পারবে না।
মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ী ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তারও করেন। তবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অপরাধীরা অনেক সময় আইনের আওতার বাইরে থেকে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বন্ধুদের চাপ, একাকিত্ব, পরিবারের অন্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধবের মাদক গ্রহণ, বিষন্নতা, হতাশা, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা শাসন, অভিভাবকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, বিচ্ছেদ, সন্তানকে সময় না দেয়ার প্রবণতা- এর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, গোটা দেশ জুড়ে মাদক ভয়ঙ্কর থাবা বিস্তার করেছে। শুধু শহর নয় প্রত্যন্ত গ্রামেও অবাধে চলছে মাদক ব্যবসা। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে সব ধরনের মাদক। ফোন করলেই বাসায় চলে আসছে এসব মরণ নেশা। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে প্রসারও। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবাধে আসছে মাদকদ্রব্য।
তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই এখন সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য এবং বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কি দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মাদকের থাবা নেই। দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এই মরণ নেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ। সম্প্রতি ইয়াবার যেসব চালান ধরা পড়েছে সেখানেও দেখা যায় মিয়ানমারের নাগরিকরা জড়িত। টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার থেকে বেশিরভাগ মাদক আমাদের দেশে আসে। এছাড়াও রয়েছে মাদকের বিভিন্ন রুট। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরা পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে।
তিনি আরও বলেন, মাদকের ভয়াল থাবায় জরাজীর্ণ দেশের সোনালি এক প্রজন্ম। যে প্রজন্মের সময় কাটতো বিদ্যালয়ের বারান্দায়, বন্ধুদের আড্ডায় থেকে শুরু করে বিস্তীর্ণ খেলার মাঠে। যারা বড় হয়ে উপহার দিতো এক সোনালি বাংলাদেশ।অথচ, স্বপ্নের মতো সেই প্রজন্ম আজ মাদকের ভয়াল থাবায় নাস্তানাবুদ! ভয়াল এই থাবা প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ যেমন করছে অনিশ্চিত, ঠিক তেমনি ধুঁকে ধুঁকে ছিন্ন করছে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মাদকাশক্তি আধনিক সভ্যতার বিপজ্জনক রোগ। এইডস, ক্যান্সারের মতো মাদকাশক্তি ও ভয়াবহ রোগ। বর্তমান বিশ্বে পারমানবিক মারণাস্ত্রের চেয়েও ভয়ংক রূপ নিয়েছে মাদকাসক্তি। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের জাতির ভবিষ্যত যুব সমাজকে। অকালে ঝড়ে যাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। মাদকের কারণে দাম্পত্য জীবনে কলহের জেরধরে ভেঙ্গে যাচ্ছে অসংখ্য সুখের সংসার। এটি আজ প্রমাণিত সত্য যে, মাদক সব অপকর্ম ও অশ্লীলতার মূল।
(বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, এই মাদকের ভয়াল থাবা থেকে নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে এবং এসব মাদক ব্যবসায়ী ও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমাতে দরকার সামাজিক নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম ঢাকা সহ দেশের প্রত্যেকটা স্থানীয় এসব মাদকবিরোধী সামাজিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
মাদক নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজকের-প্রথম পর্ব! বিস্তারিত থাকছে দ্বিতীয় পর্বে.!
Leave a Reply