লেখা: মোঃ আবু মুসা আসারি
আজকের যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করছে, তেমনি এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে নানা চিন্তা-ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এক সময় যা কেবল ফিল্মের কল্পকাহিনী ছিল, তা এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। বিশেষত, ২০২৩ সালের মধ্যে AI-এর বাজারের আকার প্রায় ৯৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২১-এর তুলনায় প্রায় ৩০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, এই বৃদ্ধি কী আমাদের জন্য একটি সুযোগ, না নয়া বিপদের অশনি সংকেত? আসুন, আমরা বিস্তারিতভাবে দেখবো AI-এর প্রভাব, সুবিধা, বিপদ এবং এর ভবিষ্যৎ।
—
AI-এর বিভিন্ন সুবিধা এবং সম্ভাবনা
১. চিকিৎসায় উন্নতি:
এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসার খাতে এক বিপ্লবের সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে AI-এর মাধ্যমে দ্রুত এবং সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের IBM Watson ক্যান্সার চিকিৎসায় অত্যন্ত সফলভাবে কাজ করছে। চিকিৎসকরা AI-এর সাহায্যে রোগীর চিকিৎসার পরামর্শ ও চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করছেন যা অনেকাংশে সময় বাঁচাতে সাহায্য করছে। বিশেষভাবে, AI চিত্র বিশ্লেষণ (Image analysis) এবং রোগের পূর্বাভাস ক্ষেত্রে AI সাফল্য অর্জন করেছে।
উদাহরণ: মস্তিষ্কের টিউমার শনাক্তকরণে AI, বিশেষ করে DeepMind (গুগল-এর একটি কোম্পানি) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তাদের প্রযুক্তি ২০১৭ সালে বস্টন হাসপাতালে প্রায় ৫০ হাজার রোগীর মস্তিষ্কের স্ক্যান বিশ্লেষণ করে সঠিক রোগের পূর্বাভাস দিয়েছে।
২. কৃষিতে প্রযুক্তির প্রভাব:
AI-based Precision Agriculture বা সঠিক কৃষি প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষকরা কেবল ফসল উৎপাদন বাড়াচ্ছেন না, বরং পরিবেশের উপরও কম প্রভাব ফেলছেন। AI ড্রোনের মাধ্যমে ফসলের মনিটরিং ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে সঠিক সেচ এবং সার প্রয়োগ নিশ্চিত করা হচ্ছে।
উদাহরণ: ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে AI ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া, কৃষকরা ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য স্যাটেলাইট ও সেন্সর ব্যবহার করছেন যা পানির স্তরের অবস্থা, মাটি সম্পর্কিত তথ্য এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস সরবরাহ করছে।
৩. স্মার্ট সিটি এবং যানবাহন ব্যবস্থাপনা:
এআই-এর সাহায্যে শহরগুলোকে আরও স্মার্ট এবং পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব হচ্ছে। সিটি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সঠিক ব্যবস্থাপনা, এমনকি সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর ক্ষেত্রে AI উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে শহরের যানজট, দূষণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হচ্ছে।
উদাহরণ: চীনের শেনজেন শহরে AI-ভিত্তিক ট্রাফিক সিস্টেম চালু রয়েছে যা ট্রাফিক জ্যাম কমাতে সহায়তা করছে এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর পাশাপাশি যানবাহনের গতিপথ নির্ধারণে দক্ষতা আনছে।
—
AI-এর বিপদ এবং অন্ধকার দিক
১. কর্মসংস্থান সংকট:
বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, AI-এর দ্রুত বিস্তার কর্মসংস্থানের বাজারে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। বিশেষ করে, রুটিন ভিত্তিক কাজগুলি যেমন—কন্টেন্ট রাইটিং, ডেটা এন্ট্রি, কল সেন্টার সেবা এবং এমনকি গুদামজাতকরণের মতো কাজগুলি সহজেই মেশিন দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকরি হারাতে পারে।
উদাহরণ: ক্যালিফোর্নিয়ার McKinsey Global Institute এর একটি রিপোর্ট বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় ৮৫ মিলিয়ন চাকরি বিলুপ্ত হতে পারে। বাংলাদেশেও এমন চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষত কল সেন্টার, ব্যাংকিং সেবা, টেলিকমিউনিকেশন, ডেটা এন্ট্রি ও গ্রাফিক ডিজাইন এর মতো খাতে।
২. ডিজিটাল বৈষম্য এবং প্রযুক্তির শোষণ:
বিশ্বে AI প্রযুক্তির মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে উন্নত দেশগুলির প্রযুক্তি ব্যবহার অন্য দেশগুলির তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ, এআই-নির্ভর সমাজে পিছিয়ে পড়তে পারে এবং তারা প্রযুক্তিগত উপনিবেশের শিকার হতে পারে।
উদাহরণ: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে AI প্রযুক্তি নিয়ে উন্নত দেশগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং গবেষণা চললেও, এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর AI ব্যবহার এখনো সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকান দেশগুলিতে AI-ভিত্তিক শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
৩. গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি:
AI-এর মাধ্যমে বৃহত্তর পরিসরে ডেটা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, যা মানুষের গোপনীয়তার লঙ্ঘন ঘটাতে পারে। একটি AI সিস্টেম যখন মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে, তখন এটি শত্রুদের দ্বারা সহজেই অপব্যবহার হতে পারে।
উদাহরণ: ২০১৮ সালে Cambridge Analytica কেলেঙ্কারি এর প্রমাণ দেয়, যেখানে AI প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল।
—
বিশ্বনেতাদের সতর্কতা ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ:
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এলন মাস্ক, এবং ইউভাল নোয়া হারারি সকলেই AI-এর সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তারা বিশ্বাস করেন, যদি AI সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে এটি মানবজাতির জন্য এক বিপজ্জনক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
স্টিফেন হকিং বলেছিলেন,
> “AI যদি কখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারায়, তবে তা মানব জাতির জন্য মৃত্যুর কারণ হতে পারে।”
এছাড়া, এলন মাস্ক বলেছেন,
> “AI-এর উন্নতি একটি সাংকেতিক বিপদ, যার জন্য আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এটি একসময় মানবতাকে অপ্রয়োজনীয় করে দিতে পারে।”
—
বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:
বাংলাদেশে AI প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে সঠিক নীতিমালা এবং আইনি কাঠামো তৈরি না করলে এর বিপদও দেখা দিতে পারে। তাই, আমাদের এখনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত:
1. AI নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন: এআই প্রযুক্তির ব্যবহারে গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, এবং নৈতিকতা বজায় রাখতে সুনির্দিষ্ট আইন তৈরি করতে হবে।
2. প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে AI বিষয়ক নতুন পাঠ্যক্রম প্রবর্তন করতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্মের কাছে এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার পৌঁছায়।
3. প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও দেশীয় স্টার্টআপদের সমর্থন: দেশে AI প্রযুক্তি নিয়ে উদ্ভাবনী কাজ বাড়ানোর জন্য সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফান্ডিং এবং সমর্থন প্রদান করতে হবে।
—
উপসংহার: দৃষ্টিভঙ্গি এবং সতর্কতা
এআই প্রযুক্তির সুবিধা এবং বিপদ উভয়ই বাস্তব। একদিকে এটি আমাদের জীবনকে আরও উন্নত ও সহজ করে তুলতে পারে, অন্যদিকে এর নিয়ন্ত্রণ হারানো আমাদেরকে বিপদের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে এখনই প্রয়োজন AI-এর সম্ভাবনা ও বিপদের উপর সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে সামগ্রিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ।
তবে, যেহেতু AI-এর নিয়ন্ত্রণে মানুষের হাত রয়েছে, আমাদের উচিত এটি মানবিক কল্যাণে ব্যবহার করা, যাতে সভ্যতা আরও এগিয়ে যায় এবং পৃথিবী এক নতুন আধুনিক যুগে প্রবেশ করতে পারে।
Leave a Reply