২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘বরবাদ’, মেহেদী হাসান হৃদয় পরিচালিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার একটি রোমান্টিক অ্যাকশন থ্রিলার, ঢালিউডের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র। শাকিব খানের ক্যারিসম্যাটিক উপস্থিতি, ইধিকা পালের স্নিগ্ধ অভিনয়, এবং যিশু সেনগুপ্ত ও মিশা সওদাগরের মতো শক্তিশালী সহশিল্পীদের সমন্বয়ে এই সিনেমা দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। তবে, এর গল্পের গঠন, কিছু ক্লিশে উপাদান এবং প্রযোজনা সংক্রান্ত বিতর্ক এটিকে একটি নিখুঁত সিনেমা হতে বাধা দিয়েছে। এই রিভিউতে ‘বরবাদ’-এর গল্প, অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনা, এবং সামাজিক ও শৈল্পিক প্রভাবের গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা দর্শকদের এই চলচ্চিত্রের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে সহায়তা করবে।
গল্পের গঠন ও থিম
‘বরবাদ’ একটি বহুমাত্রিক গল্প, যা প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধ এবং ন্যায়বিচারের মধ্যে দোল খায়। আরিয়ান মির্জা (শাকিব খান), একজন তরুণ, প্রেমে পড়ে নীতু (ইধিকা পাল)-এর হাতে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। এই ঘটনা তাকে মাদকাসক্তি ও অপরাধের অন্ধকার জগতে ঠেলে দেয়। তার বাবা আদিব মির্জা (যিশু সেনগুপ্ত) তাকে এই অন্ধকার থেকে বের করে আনতে এবং নীতুর বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। গল্পটি রোমান্টিক মুহূর্ত থেকে তীব্র অ্যাকশন এবং আদালতের নাটকীয় দৃশ্য পর্যন্ত বিস্তৃত।
গল্পের শক্তি এর আবেগঘন গভীরতায়। আরিয়ানের মানসিক যন্ত্রণা, তার হারানো ভালোবাসা এবং প্রতিশোধের তীব্র আকাঙ্ক্ষা দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে যায়। বিশেষ করে মাদকাসক্তির দৃশ্যগুলোতে আরিয়ানের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যা সমাজের এই সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে, গল্পের দ্বিতীয়ার্ধে আদালতের দৃশ্যগুলো কিছুটা ক্লিশে এবং অবাস্তব মনে হয়। আধুনিক আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে এই দৃশ্যগুলোর সামঞ্জস্যহীনতা গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করে। এছাড়া, নীতুর চরিত্রের পটভূমি এবং উদ্দেশ্য আরও গভীরভাবে প্রকাশ করা যেত, যা গল্পে আরও জটিলতা যোগ করত।
থিমের দিক থেকে, ‘বরবাদ’ প্রেমের ধ্বংসাত্মক শক্তি এবং প্রতিশোধের পরিণতির উপর আলোকপাত করে। এটি একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি এবং সমাজের অন্ধকার দিকগুলোর একটি প্রতিচ্ছবি। তবে, গল্পের কিছু অংশে প্লটের প্রেডিক্টেবিলিটি এবং বাণিজ্যিক উপাদানের অতিরিক্ত প্রাধান্য এটিকে আরও শৈল্পিক উচ্চতায় পৌঁছাতে বাধা দেয়।
অভিনয়: শাকিব খানের নতুন মাত্রা
শাকিব খান (আরিয়ান মির্জা): শাকিব খান এই সিনেমায় তার ক্যারিয়ারের একটি নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছেন। আরিয়ানের চরিত্রে তার আবেগঘন অভিনয়, বিশেষ করে মাদকাসক্তির দৃশ্যগুলোতে, দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। তিনি রোমান্টিক নায়ক থেকে ভাঙা হৃদয়ের প্রতিশোধপরায়ণ যোদ্ধায় রূপান্তরে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তার শারীরিক রূপান্তর এবং অভিব্যক্তি গল্পের তীব্রতাকে জীবন্ত করে তুলেছে। তবে, কিছু অ্যাকশন দৃশ্যে তার অভিনয় কিছুটা একঘেয়ে মনে হয়েছে, যা সম্ভবত স্ক্রিপ্টের সীমাবদ্ধতার কারণ।
– ইধিকা পাল (নীতু): ইধিকা পাল নীতুর চরিত্রে একটি স্নিগ্ধ উপস্থিতি রেখেছেন। শাকিবের সঙ্গে তার রোমান্টিক রসায়ন দর্শকদের মন জয় করেছে। তবে, তার চরিত্রের গভীরতা সীমিত, এবং দ্বিতীয়ার্ধে তার ভূমিকা কিছুটা পটভূমিতে চলে যায়। আরও শক্তিশালী সংলাপ এবং পটভূমির গল্প তার অভিনয়কে আরও উজ্জ্বল করতে পারত।
– যিশু সেনগুপ্ত (আদিব মির্জা: ২৩ বছর পর বাংলাদেশি সিনেমায় ফিরে যিশু সেনগুপ্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার শান্ত কিন্তু দৃঢ় অভিনয় গল্পে একটি পিতৃসুলভ গভীরতা যোগ করেছে। তার উপস্থিতি শাকিবের চরিত্রের জন্য একটি শক্তিশালী নৈতিক কাঠামো প্রদান করে।
-মিশা সওদাগর ও অন্যান্য: মিশা সওদাগরের অভিনয় গল্পের অন্ধকার দিকগুলোকে জীবন্ত করেছে। শহীদুজ্জামান সেলিম, মামুনুর রশীদ এবং ফজলুর রহমান বাবুর মতো অভিনেতারা তাদের স্বল্প ভূমিকায়ও প্রভাব ফেলেছেন। তবে, কিছু সাপোর্টিং চরিত্রের গল্পে আরও গভীরতা যোগ করা যেত।
পরিচালনা: মেহেদী হাসান হৃদয়ের প্রথম পদক্ষেপ
মেহেদী হাসান হৃদয় তার প্রথম সিনেমাতেই একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি শাকিব খানের বহুমুখী অভিনয় দক্ষতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন এবং গল্পের আবেগঘন মুহূর্তগুলোকে দৃশ্যমানভাবে উপস্থাপন করেছেন। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে তার কোরিওগ্রাফি এবং ক্যামেরার ব্যবহার ঢালিউডের মানকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে।
তবে, পরিচালক হিসেবে তার কিছু সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ। আদালতের দৃশ্যগুলোতে বাস্তবতার অভাব এবং গল্পের কিছু অংশে প্লটের প্রেডিক্টেবিলিটি তার দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া, সিনেমার দৈর্ঘ্য (প্রায় ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট) কিছুটা দীর্ঘ মনে হয়, যা আরও ক্রিস্প এডিটিংয়ের মাধ্যমে এড়ানো যেত।
প্রযোজনা ও প্রযুক্তিগত দিক
১৫-১৮ কোটি টাকা বাজেটে নির্মিত ‘বরবাদ’ বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রগুলোর একটি। সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে বিতর্ক (শৈলেশ আওয়াস্থি বনাম রাজু রাজ) থাকলেও, এর ভিজ্যুয়াল গুণমান ঢালিউডের জন্য একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। পাহাড়, নদী এবং শহরের দৃশ্যগুলোতে ক্যামেরার কাজ দর্শনীয়। সেট ডিজাইন, বিশেষ করে অ্যাকশন দৃশ্য এবং আদালতের সেট, বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য উপযুক্ত।
তবে, সাউন্ড ডিজাইন কিছু ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। বিশেষ করে অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর কখনো কখনো সংলাপকে ছাপিয়ে গেছে। এডিটিং আরও শক্তিশালী হলে সিনেমার গতি আরও আকর্ষণীয় হতো।
সঙ্গীত: হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া সুর
‘বরবাদ’-এর সঙ্গীত এবং গান সিনেমার অন্যতম শক্তি। “তোমার ছাড়া” এবং “নিঃশ্বাস” গান দুটি দর্শকদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। “প্রতি নিঃশ্বাসে নাম তোমার” গানটি রোমান্টিক মুহূর্তগুলোকে আরও গভীর করেছে, এবং “জানি না কি করে তুমি এসে” অ্যাকশন দৃশ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর গল্পের তীব্রতা বাড়িয়েছে, যদিও কিছু ক্ষেত্রে এটি অতিরিক্ত নাটকীয় মনে হয়েছে।
বক্স অফিস ও দর্শক প্রতিক্রিয়া
‘বরবাদ’ মুক্তির প্রথম সপ্তাহে ২৭.৪৩ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করে এবং ১১ দিনে ৩৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রযোজক শাহরিন আক্তার সুমি আশাবাদী যে, সিনেমাটি ১০০ কোটি টাকার মাইলফলক স্পর্শ করতে পারে। আইএমডিবি-তে ৭.৪ রেটিং এবং জনপ্রিয় সিনেমার তালিকায় ৪৪তম স্থান অর্জন বাংলাদেশি সিনেমার জন্য একটি বড় অর্জন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্যে মুক্তির পর হাউসফুল শো প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।
তবে, দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। শাকিব খানের ফ্যানরা তার অভিনয় এবং রোমান্টিক দৃশ্যগুলোর প্রশংসা করেছেন, কিন্তু কিছু দর্শক আদালতের দৃশ্য এবং গল্পের কিছু অংশকে “পুরনো ধাঁচের” বলে সমালোচনা করেছেন। সামাজিক মাধ্যমে সিনেমাটোগ্রাফি বিতর্ক এবং আয় নিয়ে বিতর্কও আলোচনার বিষয় হয়েছে।
সামাজিক ও শৈল্পিক প্রভাব
‘বরবাদ’ ঢালিউডের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা, কারণ এটি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি সিনেমার সম্ভাবনা তুলে ধরেছে। শাকিব খানের নতুন রূপ এবং ভারতীয় শিল্পীদের সঙ্গে সহযোগিতা দুই দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। সিনেমাটি মাদকাসক্তি এবং প্রতিশোধের মতো সামাজিক বিষয়গুলো তুলে ধরেছে, যা তরুণ দর্শকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে।
তবে, সিনেমাটি কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক উপাদানের উপর অতিরিক্ত নির্ভর করেছে, যা এর শৈল্পিক গভীরতাকে সীমিত করেছে। আদালতের দৃশ্যগুলোর অবাস্তব উপস্থাপনা এবং কিছু ক্লিশে সংলাপ সমসাময়িক দর্শকদের কাছে পুরনো মনে হতে পারে।
ইতিবাচক দিক
1. শাকিব খানের অভিনয়: তার আবেগঘন এবং বহুমুখী অভিনয় সিনেমার প্রাণ।
2. সিনেমাটোগ্রাফি: দৃশ্যমান উপস্থাপনা ঢালিউডের জন্য একটি নতুন মানদণ্ড।
3. সঙ্গীত: গান এবং ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর গল্পের তীব্রতা বাড়িয়েছে।
4.আন্তর্জাতিক সাফল্য: আইএমডিবি তালিকায় স্থান এবং বিদেশে মুক্তি বাংলাদেশি সিনেমার সম্ভাবনা তুলে ধরেছে।
5.সামাজিক বার্তা: মাদকাসক্তি এবং প্রতিশোধের প্রভাব নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি।
নেতিবাচক দিক
1.গল্পের দুর্বলতা: আদালতের দৃশ্য এবং কিছু অংশে প্রেডিক্টেবিলিটি।
2.সাপোর্টিং চরিত্র: নীতু এবং অন্যান্য চরিত্রের গভীরতা বাড়ানো যেত।
3.অতিরিক্ত বাণিজ্যিকতা: ক্লিশে উপাদান এবং দীর্ঘ দৈর্ঘ্য গল্পের গতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
4.বিতর্ক: সিনেমাটোগ্রাফি কৃতিত্ব এবং আয় নিয়ে বিতর্ক সিনেমার ইমেজের উপর প্রভাব ফেলেছে।
5.সাউন্ড ডিজাইন: কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সংলাপকে ছাপিয়ে গেছে।
উপসংহার
‘বরবাদ’ একটি বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে দর্শকদের বিনোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে সফল, তবে এটি শৈল্পিক গভীরতার দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। শাকিব খানের অসাধারণ অভিনয়, ইধিকা পালের সঙ্গে তার রসায়ন, এবং মেহেদী হাসান হৃদয়ের উচ্চাভিলাষী পরিচালনা এই সিনেমাকে ঢালিউডের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন করেছে। তবে, গল্পের কিছু দুর্বলতা, ক্লিশে উপাদান এবং প্রযোজনা সংক্রান্ত বিতর্ক এটিকে একটি নিখুঁত সিনেমা হতে বাধা দিয়েছে।
যারা শাকিব খানের ফ্যান বা রোমান্টিক অ্যাকশন ঘরানার সিনেমা পছন্দ করেন, তাদের জন্য ‘বরবাদ’ একটি অবশ্যদর্শনীয় চলচ্চিত্র। তবে, যারা গল্পে গভীরতা বা বাস্তবতা খুঁজছেন, তারা কিছুটা হতাশ হতে পারেন। ঢালিউডের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে, ‘বরবাদ’ একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে, তবে আরও পরিশীলিত গল্প এবং প্রযোজনা গুণমান এই শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
রেটিং: ৭.১/১০
সুপারিশ: পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে হলে গিয়ে উপভোগ করার জন্য উপযুক্ত। সিনেমা হলে দেখে নির্মাতাদের সমর্থন করুন এবং পাইরেসি থেকে বিরত থাকুন।
লেখক
মোঃ আবু মুসা আসারি
ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: musasirajofficial@gmail.com
Leave a Reply