মোঃ আবু মুসা আসারি
স্ট্যাফ রিপোর্টার
ঢাকার প্রথম লাইব্রেরী হলো ‘রাজা রামমোহন রায়’ লাইব্রেরী যা প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজের হাত ধরে। ১৮৬৯ সালে ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অভয়চন্দ্র দাশ পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ১৯১০ সাল থেকে নিজস্ব ভবনে যাত্রা শুরু হয় লাইব্রেরীটির।
বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের পদধূলি পড়েছে এই লাইব্রেরীতে। ১৯২৬ সালে শ্রী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা লীলা নাগের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী) আমন্ত্রণে একটি নারী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম এই লাইব্রেরীতে আসেন। এমনকি সেই সমাবেশে বক্তব্যও দেন তিনি। এছাড়াও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের মত গুণীজনদের পদচারনায় সর্বদা মুখরিত থাকত লাইব্রেরীটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় এই লাইব্রেরীতে নিয়মিত পড়তে আসতেন বহুভাষাবিদ ও পন্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৩০ সালে এই লাইব্রেরীতেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ এবং লাবণ্য গুপ্ত। কবি জীবনানন্দ দাশের মা কবি কুসুমকুমারী দাশ, কবি বুদ্ধদেব বসু, মুহম্মদ আব্দুল হাই, কাজী মোতাহার হোসেন, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মত মনীষীরা নিয়মিত যাতায়াত করতেন এখানে। এছাড়াও কবি সুফিয়া কামাল এবং শামসুর রাহমানও এই পাঠাগারের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন।
স্মৃতি বিজড়িত এই লাইব্রেরীতে এক সময় প্রায় ৩০ হাজারের বেশি বই সংরক্ষিত ছিল। রাজা রামমোহন রায়ের মুদ্রিত পুস্তকের প্রথম সংস্করণ, বেদান্ত দর্শন, পারসি ভাষায় লেখা তোফায়াতুল মোহাম্মাদিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্রসহ সমকালীন সাহিত্যিকদের রচনাবলীর প্রথম সংস্করণ, গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত পবিত্র কোরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদের সংস্করণ, ২৫০ বছর পূর্বে খ্রিস্টান মিশনারি কর্তৃক ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় ছাপানো বইয়ের কপি এই লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক বঙ্গদর্শন পত্রিকার মূল কপি ও পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত কপি, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা, ঢাকা নিউজ, বেঙ্গল টাইমস, তত্ত্ববোধিনী, তত্ত্বকোমুদি, শান্তিনিকেতন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, হিতবাদী, বসুমতি, বিচিত্রা ও ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার প্রথম থেকে শেষ সংখ্যা পর্যন্ত পত্রিকাগুলোর কপি সংরক্ষিত ছিল এখানে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী ৫০ বছরের সকল সরকারি গেজেট।
শতবর্ষী এই লাইব্রেরীটি একাধারে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক অনন্য সাক্ষী হিসেবে পার করেছে প্রায় ১৫৫ বছর। বর্তমানে এই লাইব্রেরীর দুর্লভ বইগুলোর কোনটিরই অস্তিত্ব নেই। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে নিজেদের ক্যাম্প বসিয়েছিল এখানে। এখানকার সমস্ত বই লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল তারা। এমনকি কেজি দরে বিক্রি করে ঠোঙা বানানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়েছিল বইগুলো! ১৯৭২ সালের ১০ই মে দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫শে মার্চের এক রাতেই এখন থেকে লোপাট হয়েছিল প্রায় ২০ হাজারের বেশি দুষ্প্রাপ্য বই ও নথি। স্বাধীনতার পর কর্তৃপক্ষ লুট হওয়া বইগুলো ফেরাতে চড়ামূল্যে কেনার বিজ্ঞাপন করলেও কোন সাড়া মেলেনি। পুরান ঢাকার তিন নং লয়াল স্ট্রিট গলির ‘রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার’ ভবনটির অবস্থা এখন সংকটাপন্ন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক জরাজীর্ণ এই ভবনটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়ায় ২০০৪-২০১৪ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল লাইব্রেরীটি। ২০১৪ সালে পুনরায় এর কার্যক্রম শুরু করা হয়। বর্তমানে এর জৌলুস একদম হারিয়ে গেছে। লাইব্রেরীটির সংগ্রহে রয়েছে মাত্র ৬০০টি বই; পাঠক প্রায় নেই বললেই চলে। দেয়ালে ধরেছে ফাটল, খসে পড়েছে পলেস্তারা, ছুটে যাচ্ছে বইয়ের বাঁধাই। আইনি জটিলতায় থেমে আছে মূল ভবনের সংস্কারের কাজ। ভবন সংস্কারের জন্য ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে বার বার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এমন চলতে থাকলে হয়ত কালের পরিক্রমায় একসময় হারিয়ে যাবে লাইব্রেরীটি; ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে কালের সাক্ষী ‘রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার’-এর নাম!
Leave a Reply