মোঃ আবু মুসা আসারি( সিনিয়র রিপোর্টার)
বাংলা সংস্কৃতি এক বহুমাত্রিক ও বহুত্ববাদী মানবিক ঐতিহ্য, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে নানা ধর্ম, ভাষা, গোত্র ও চেতনার সম্মিলনে। এই সাংস্কৃতিক বুননে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও উপজাতীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি মুসলমানদের অবদানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ দুঃখজনকভাবে, বহু সময় এক পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি সংস্কৃতিকে কেবলমাত্র হিন্দু অভিজাত সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বলে উপস্থাপন করে, যেখানে মুসলমানদের অবদানকে হেয় করা হয় বা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন এক আন্তরিক ও ন্যায্য সাংস্কৃতিক পুনর্মূল্যায়ন, যেখানে মুসলমানদের অংশগ্রহণ, সৃজনশীলতা ও মানবিক বোধকে তার যথাযথ স্থান দেওয়া হয়।
ইসলামের আগমন ও বাঙালিয়ানার রূপান্তর
বাংলার মাটি ইসলামের সংস্পর্শে আসে প্রধানত আরব, তুর্কি, ইরানি ও আফগান মুসলমানদের মাধ্যমে। তবে ইসলাম শুধু একটি ধর্ম হিসেবে নয়, বরং একটি জীবনব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বাংলার সমাজে প্রবেশ করে। ইসলামের মর্মবাণী—তাওহিদ, ন্যায়, সাম্য, মানবিকতা ও আত্মশুদ্ধি—বাংলার গ্রামীণ মানুষের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। মধ্যযুগে আগত সুফি সাধকরা যেমন ছিলেন ধর্ম প্রচারক, তেমনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক ও সাংস্কৃতিক সংহতির দূত। তাঁরা স্থানীয় ভাষা, রীতিনীতি ও কাব্যধারাকে গ্রহণ করে ইসলামের ভাবধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
সুফি দর্শনের সঙ্গে বাংলার সহজিয়া, বৈষ্ণব ও লোকধর্মের ভাববিনিময় এক মরমি ঐতিহ্যের জন্ম দেয়। লালন, হাছন রাজা, পীর ফকিরদের গান ও দর্শন—এই সবই ধর্মীয় সীমানা অতিক্রম করে এক গভীর মানবতাবাদী সংস্কৃতির প্রতিফলন। মুসলিম পীর-আউলিয়ার দরগা যেমন মানুষের মিলনস্থল, তেমনি তাঁদের ভাবনা বাঙালির সামষ্টিক মানসের অংশ হয়ে ওঠে।
সাহিত্য ও ভাষার বহুবর্ণতা
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশেও মুসলমানদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুঘল যুগে বাংলা সাহিত্য প্রধানত ছিল হিন্দু রাজকীয় অভিজাতদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত, কিন্তু ১৮-১৯ শতকে মুসলিম লেখকদের একটি বিশাল অংশ গ্রামীণ ও প্রান্তিক সমাজের ভাষায় নতুন ধারার সাহিত্য সৃষ্টি করেন। এই সাহিত্য ইসলামি নৈতিকতা, সামাজিক বার্তা এবং দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা—সবই একত্রে বহন করে।
মহাকাব্যধর্মী সাহিত্য যেমন “গাজী কালু-চম্পাবতী”, “আমির হামজা”, “সত্যপীরের পুঁথি”—এসবই ইসলামী ভাবধারাকে লোকসাহিত্যের মাধ্যমে আত্মীকরণ করে। একদিকে এগুলো ধর্মীয় অনুষঙ্গ বহন করে, অন্যদিকে এগুলো বাঙালির নিজস্ব রূপকথা, কিংবদন্তি ও পল্লী কল্পনার এক অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান, আব্দুল হাকিম, কাজী দৌলত প্রমুখ, যারা বাংলা সাহিত্যকে ইসলামি ভাব, সূক্ষ্ম কাব্যিকতা এবং সামাজিক সমালোচনার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন।
সমাজ-সংস্কৃতিতে মুসলমানদের আন্তরিক অংশগ্রহণ
বাংলার সমাজজীবনে মুসলমানরা কেবলমাত্র ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কৃষিকাজ, হস্তশিল্প, সংগীত, নৌপরিবহন, মৃৎশিল্পসহ নানা শৈল্পিক কর্মকাণ্ডে তাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তাঁরা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় বজায় রেখে বৃহত্তর সমাজে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তুলেছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো উৎসব ও পার্বণের সংমিশ্রণ। মুসলমানদের ঈদ, শবে বরাত, মহরম ইত্যাদি যেমন ধর্মীয় উৎসব, তেমনি এসব পার্বণ স্থানীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে পল্লী মেলা, গানের আসর, পিঠা উৎসব ও লাঠিখেলার মতো লোকজ বিনোদনের মাধ্যমে এক নতুন রূপ নেয়। বাংলার মাজারসংস্কৃতি এক বিশাল উদাহরণ, যেখানে ধর্মীয় ভক্তি এবং লোকসংস্কৃতির মিলন ঘটে।
স্থাপত্য, পোশাক ও খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য
মুসলমানদের আগমনের পর বাংলায় গড়ে ওঠে এক অনন্য স্থাপত্যশৈলী—যা ইসলামি গম্বুজ, খিলান, মিনার ও নকশাকারের বৈশিষ্ট্যসমূহকে স্থানীয় উপকরণ ও কৌশলের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করে। ষাট গম্বুজ মসজিদ, চৌগাছা মসজিদ, বাগেরহাট, পাণ্ডুয়া, সোনারগাঁয়ের স্থাপত্য নিদর্শনগুলো আজও সেই চিরস্থায়ী শিল্পকীর্তির সাক্ষ্য বহন করে।
পোশাকেও এসেছে উল্লেখযোগ্য প্রভাব। মুসলমানদের হাত ধরে বাংলায় জনপ্রিয় হয় ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, টুপি, হিজাব ইত্যাদি পোশাক। খাদ্যসংস্কৃতিতে বিরিয়ানি, কাবাব, শিরমাল, হালিম, কোরমা, ফিরনি, সেমাই—এসব শুধু খাবার নয়, বরং একেকটি সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি।
ধর্ম ও সংস্কৃতির সংলাপ
ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সংঘর্ষ নয়, বরং সংলাপ ও সমঝোতার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন বাংলার মুসলমানেরা। বাংলা ভাষায় আজান, বাংলা খুতবা, বাংলা ইসলামী সংগীত, কবিতা—সবই এই সংলাপের বাস্তব দৃষ্টান্ত। ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনার সংমিশ্রণ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, যেখানে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাসংগ্রামী। ভাষা শহীদদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম, যা স্পষ্ট করে দেয় যে ‘ধর্ম ও বাঙালিয়ানার দ্বন্দ্ব’ একটি আরোপিত ধারণা।
শিক্ষায় মুসলমানদের সংগ্রাম ও অগ্রগতি
ঔপনিবেশিক আমলে মুসলমানরা শিক্ষায় কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও ১৯ শতক থেকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আব্দুল লতিফ, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি নজরুল ইসলাম প্রমুখ শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিকরা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। মুসলিম সমাজের আধুনিকায়ন ও আত্মবিশ্বাস গঠনে এইসব চিন্তাবিদরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
উপসংহার: বহুত্ববাদী জাতীয় পরিচয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা
বাংলা সংস্কৃতির গঠনে মুসলমানরা কেবল অংশগ্রহণকারী নয়, বরং সমানভাবে নির্মাতা। তাঁদের অবদানকে উপেক্ষা করে একটি খণ্ডিত বাঙালি পরিচয়ের চর্চা যেমন বিভাজন সৃষ্টি করে, তেমনি ইতিহাস ও বাস্তবতার অপব্যাখ্যা ঘটায়। আজকের দিনে দরকার সেই সংস্কৃতিকে উদযাপন করা, যা ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাইকে একত্র করে। একমাত্র এই উদার সাংস্কৃতিক স্বীকৃতিই আমাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় পরিচয়কে শক্তিশালী ও মানবিক করতে পারে।
Leave a Reply