হাকিকুল ইসলাম খোকন,
হরিবল অবস্থা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন দফতরে। বছরের পর বছর মাস্টার হিয়ারিংয়ের অপেক্ষায় থাকা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন-বিরোধী পরিক্রমায় গভীর হতাশায় নিপতিত হয়েছেন। মাস খানেক আগে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনকারিরা শুনানীর তারিখ পাচ্ছেন। দ্রুত সে আবেদন নিষ্পত্তির তাগিদ দেয়া হচ্ছে। এ যেন ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’র মত অবস্থা। নিউইয়র্ক অঞ্চলে অভিবাসন ইস্যুতে খ্যাতি অর্জনকারি এটর্নী জান্নাতুল রুমা এ প্রসঙ্গে এ সংবাদদাতাকে ১৭ এপ্রিল বৃহস্প্রতিবার অপরাহ্নে বলেছিলেন,আবেদন প্রেরণের পরই এমন নোটিশ দেখে আমি হতবাক। আমার ক্লায়েন্টেরও প্রস্তুতি ছিল না। তবুও শুনানীতে সাড়া দিতে হয়েছে। সিদ্ধান্ত এখনো পাইনি। এটর্নী রুমা বললেন, এমন পরিস্থিতি সকলের জন্যেই বিব্রত। তাই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে আগ্রহীগণের উচিত হবে সমস্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পরই তা সাবমিট করার। তাহলে যত দ্রুততম সময়েই ইন্টারভিউর তারিখ দেয়া হউক না কেন-তা সমস্যা হবে না।
এটর্নী রুমা বললেন, সচরাচর এসাইলামের আবেদন সাবমিটের ৫ মাস পর ওয়ার্ক পারমিট আসে। এরপর ইন্টারভিউয়ের জন্যে অপেক্ষার পালা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একের পর এক নয়া নির্দেশনায় সবকিছু হ-য-ব-র-ল অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। ক্লায়েন্টরা যেমন স্বস্তিতে নেই, আমরা এটর্নীরাও অস্বস্তিতে পড়েছি।
এসাইলাম তথা রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুরের পর গ্রীণকার্ড পেয়েছেন-এমন লোকজনকেও নিজ দেশ ভ্রমণে সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন মৃদুভাষী এই এটর্নী। তিনি বলেন, নিজ দেশে ফিরলেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা অন্য কোন সংঘবদ্ধ চক্রের রোষানলে পড়ার আশংকা থাকার যুক্তি দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন। গ্রীণকার্ড হাতে পাবার পরই ঘনঘন নিজ দেশ ভ্রমণের পর আবার স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরছেন কীভাবে-এমন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়েছে অনেককেই। একইভাবে বছরের অধিকাংশ সময় নিজ দেশে অবস্থানকারিদেরকেও এয়ারপোর্ট/সীমান্ত ফাড়িতে কাস্টমস অফিসারের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হচ্ছে গ্রীণকার্ডধারী, এমনকি সিটিজেনদেরকেও। এমন পরিস্থিতি আর কখনো হয়নি। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম আমলেও ঘটেনি। তাই যাদেরকে বিশেষ প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় নিজ দেশে অবস্থানের প্রয়োজন রয়েছে, তারা যেন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন-এমন পরামর্শ ইমিগ্রেশনের এই এটর্নীর। সকলের উদ্দেশ্যে এটর্নী রুমা আরো বলেছেন যে, ঘরের বাইরে গেলেই যেন সকলে সাথে আইডি রাখেন।
স্টুডেন্ট ভিসাধারীরাও স্বস্তিতে নেই, পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই অনেকের ভিসা বাতিল করা হচ্ছে, কয়েক বছর আগে ট্রাফিক আইন লংঘন কিংবা দোকানে ছোটখাটো চুরির জন্যে গ্রেফতার হয়েছিলেন কিংবা টিকিট না করেই বাস/রেল স্টেশনে ঢুকেছিলেন-এমন মামুলি অপরাধ থেকে পরবর্তীতে খালাস পেলেও এখোন তা বড় ধরনের বিপত্তির কারণ হচ্ছে। এটর্নী রুমা বললেন, স্টুডেন্ট ভিসাধারীরা কেউ স্বস্তিতে নেই ট্রাম্পের গৃহিত কঠিন পদক্ষেপের কারণে। ইতিমধ্যেই অনেকের ভিসা বাতিল করা হয়েছে। এটর্নী রুমা বলেন, অনেকে ভিসার নিয়ম লংঘন করে গোপনে কাজ করছেন-এবং তা থেকেই ছোটখাটো অপরাধে জড়িত হচ্ছেন। এগুলো আগে কেউ ক্ষতিয়ে দেখেননি। এখোন ট্রাম্প প্রশাসন অজুহাত খুঁজছে ভিসা বাতিলে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেন বশির আতাল্লা এবং তার স্ত্রী জেসিকা ফাখরি কানাডায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। রোববার তারা সড়কপথে ভারমন্ট সীমান্ত ফাঁড়ি অতিক্রমকালে সিবিপি (ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বোর্ডার প্রটেকশন) কর্মকর্তারা আটকায়। ১০ বছর আগে সিটিজেন হওয়া রিয়েল এস্টেট এটর্নী বশির আতাল্লা স্থানীয় টিভিকে জানান, ওরা আমার সাথে যে আচরণ করেছে তা সচরাচর গুরুতর অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতদের জন্যে প্রযোজ্য। এটর্নী আতাল্লা বলেন, আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম ড্রাইভিং লাইসেন্সও সাথে ছিল। জীবনে কখনো কোন অপরাধে গ্রেফতারও হইনি, কিংবা আদালতেও কোন মামলা ছিল না। বশির আতাল্লা বলেন, সিবিপি কর্মকর্তারা আমাকে নিকটেই গাড়ি পার্ক করতে বলেন এবং সাথে সাথে বন্দুক উচিয়ে কাছে এসে হ্যান্ডকাফ পড়ায়। ওরা আমার হাতে প্রচন্ড আঘাত দিয়েছে। ওরা আমাকে টেনে হেঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যায়। সে সময় গাড়িতে বসে থাকা আমার স্ত্রীর ভিতসন্ত্রস্ত চেহারা আমাকে আরো অস্থির করেছিল। বশির আতাল্লা টিভিতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে আরো উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যখোন সিবিপি কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েছেন কেন তার সাথে এমন আচরণ করা হচ্ছে? জবাবে ওরা বলেছে যে,‘আমরা কিছু জানি না, শুধু গভর্ণমেন্টের নির্দেশ পালন করতে হচ্ছে।’ ‘এক পর্যায়ে ওরা আমার টেলিফোন চেক করে এবং ই-মেল পর্যালোচনা করেছে। এটি আমি করতে দিতে চাইনি। কিন্তু ওরা আমাকে ভয় দেখিয়ে বাধ্য করেছে। এমনকি তল্লাশীর পর একটি কাগজে আমার স্বাক্ষর নিয়েছে যে, ফোন ও ই-মেল তল্লাশীর অনুমতি দিয়েছিলাম বলেই ওরা তা করেছে।’
পেনসিলভেনিয়া স্টেটে জন্মগ্রহণকারি লিসা এন্ডারসন (৫৮) চিকিৎসক হিসেবে বাস করছেন কানেকটিকাট স্টেটে। তিনি হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয় থেকে একটি ই-মেল পেয়েছেন। সেখানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের। এর আগে ম্যাসেচুসেটস স্টেটের বস্টনে বসবাসরত দুই এটর্নী নিকোল মিসারোনি এবং কারমেন বেলো একইধরনের ই-মেল পেয়েছেন। তারা উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেন। অভিবাসন দফতরের সাথে কোনই সম্পর্ক নেই। তবুও কেন এমন হুমকির ই-মেল পাচ্ছেন? তারা ই-মেলকে আমলে নিয়ে অভিবাসন দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাগণের সাথে যোগাযোগ করেও সদুত্তর পাননি। অধিকন্তু তাদেরকে বলা হয়েছে ইমিগ্রেশন এটর্নীর সাথে যোগাযোগ করতে। উল্লেখ্য, এই দুই এটর্নীর ই-মেলে বলা হয়েছে যে, তাদের প্যারলের মেয়াদ ফুরিয়ে যাচ্ছে, তাই তারা যেন দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন। যদিও তারা অনেক আগেই সিটিজেন হয়েছেন।
এমনি হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যেই ম্যারিল্যান্ডের ফেডারেল আদালতের আদেশ অমান্য করে ভেনেজুয়েলার গ্যাং সদস্যদের এল সালভাদরে পাঠানোয় ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা ফৌজদারি আদালত অবমাননার অভিযোগের মুখে পড়তে পারেন বলে জানিয়েছেন ওয়াশিংটনের ডিস্ট্রিক্ট জজ জেমস বোয়াসবার্গ। বুধবার বোয়াসবার্গ তার লিখিত রায়ে বলেন, কর্মকর্তাদেরকে ফৌজদারি আদালত অবমাননার মুখোমুখি করার ‘সম্ভাব্য কারণ’ পেয়েছেন তিনি। ভেনেজুয়েলার গ্যাং সদস্যদের ১৭৯৮ সালের যুদ্ধকালীন আইনের আওতায় এল স্যালভাদরে নিয়ে যাওয়ার ফ্লাইট আটকে দিয়ে গত ১৫ মার্চে দেওয়া আদেশ ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অমান্য’ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ কারণেই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যেতে পারে।
আল সালভাদরে পাঠানো ওই অভিবাসীদের আইনজীবী ও পরিবারের সদস্যরা বলছে, যাদের পাঠানো হয়েছে তারা গ্যাং সদস্য নন, বরং সরকারের অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ না পেয়েই তারা দেশছাড়া হয়েছেন।
ট্রাম্প ২০ জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নেওয়ার পর তার প্রশাসনকে সাজার মুখোমুখি করতে অন্য কোনও আদালতের চেয়ে বোয়াসবার্গের রায়েই সরাসরি কঠোর বার্তা এসেছে এবং বিচারিক ও নির্বাহী শাখার মধ্যে সংঘাত বেড়েছে।
বোয়েসবার্গ বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন চাইলে এখনও তার নির্দেশ মেনে আদালত অবমাননার অভিযোগ এড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রশাসনকে ভেনেজুয়েলার ওই অভিবাসীদেরকে তাদের বিতাড়নের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতে লড়ার সুযোগ দিতে হবে। বিচারক এজন্য প্রশাসনকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন ।এই সময়ের মধ্যে জানাতে হবে আদেশ পালনে তারা কী পদক্ষেপ নেবে অথবা আদেশ অমান্যের জন্য কে বা কারা দায়ী, যাতে তাদের বিচার করা যায়। বিচারক উল্লেখ করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও আদালতের আদেশ নিয়ে এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নায়িব বুকেলের একটি পোস্ট পুনরায় শেয়ার করেন এবং লেখেন, “ওহ! বড্ড দেরি হয়ে গেছে।”
বিচারক লেখেন, “এ ধরনের আচরণ থেকে বোঝা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে।”বিচারক উল্লেখ করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও আদালতের আদেশ নিয়ে এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নায়িব বুকেলের একটি পোস্ট পুনরায় শেয়ার করেন এবং লেখেন, “ওহ! বড্ড দেরি হয়ে গেছে।”
বিচারক লেখেন, “এ ধরনের আচরণ থেকে বোঝা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রে আদালত এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তার প্রশাসনের নীতির বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশি মামলা চলছে।
‘ন্যাশনাল ডে অব অ্যাক্শন’
এদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন-বিরোধী অভিযানসহ নানা পদক্ষেপের প্রতিবাদে ১৯ এপ্রিল শনিবার নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, ক্যালিফোর্নিয়া, পেনসিলভেনিয়া, নিউজার্সি, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, মিশিগান, টেক্সাস-সহ ৫ স্টেটের সহ¯্রাধিক সিটিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ হবে। গত ৫ এপ্রিল সারা আমেরিকায় ব্যাপক বিক্ষোভ-সমাবেশের জের হিসেবে এটি হবে দ্বিতীয় কর্মসূচি এবং এটিকেও ব্যাপকভাবে সাফল্যমন্ডিত করার প্রস্তুতি চলছে। আয়োজক হিসেবে ‘৫০৫০১’ হিসেবে সামনে রয়েছে। অর্থাৎ ৫০ স্টেটের ৫০ বড় সিটিসহ ৪ শতাধিক স্থানে একইদিন বিক্ষোভ হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গণ-বিরোধী পদক্ষেপ রুখে দিতে। অভিবাসন, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার নিয়ে কর্মরত সংগঠনসমূহ ছাড়াও শ্রমিক-পেশাজীবী এবং ছাত্র সংগঠনগুলোও সামিল হয়েছে এই কর্মসূচিতে। নিউইয়র্ক সিটির মিডটাউনে পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে ব্রায়ান্ট পার্কে বেলা ঠিক ১২টায় অনুষ্ঠিত হবে এই স্টেটের প্রধান কর্মসূচি। সোস্যাল মিডিয়া ছাড়াও প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে চলছে প্রচারণা। ট্রাম্পের অপশাসনের পরিধি বিস্তৃত হবার সাথে সঙ্গতি রেখে দেশব্যাপী ‘ন্যাশনাল ডে অব অ্যাক্শন’ শীর্ষক এই কর্মসূচির প্রতি সর্বসাধারণের আগ্রহও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে আয়োজকরা দাবি করেছেন। এদিকে, ১৬ এপ্রিল বৃহস্প্রতিবার নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, জর্জিয়াসহ ১৬ স্টেটে একযোগে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে আইস বিলুপ্তির দাবি উঠেছে। আইসের অভিযানে অবৈধ অভিবাসীর সাথে সিটিজেনরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। গ্রীণকার্ডধারীদেরকেও গ্রেফতারের পর বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। এজন্যে আইস (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এ্যানফোর্সমেন্ট) বিলুপ্তির বিকল্প নেই বলে এসব সমাবেশের বক্তারা উল্লেখ করেছেন। অভিবাসীগণের এই আন্দোলন-কর্মসূচি অব্যাহত ছিল ১৯ এপ্রিলের দেশব্যাপী বিক্ষোভ-সমাবেশ পর্যন্ত।প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিবাসীদের অন্যায় আচরণের মাধ্যমে তাদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেক অভিবাসী ।
Leave a Reply