স ম জিয়াউর রহমান
এবার দেশের সরকারি নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্যে অর্থ লুটপাটের এক চাঞ্চল্যকর উদাহরণ সামনে এসেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন ১২ কোটি ৮১ লাখ টাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ কাজের চুক্তিপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ২০ শতাংশ লাভে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ গুরুতর চুক্তিবাণিজ্য এবং সড়ককেলেঙ্কারির পেছনে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। অভিযোগ উঠেছে, নেতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে আর্থিকভাবে লাভবান করার জন্যই সরকারি ক্রয়বিধি লঙ্ঘন করে এই কমিশন লেনদেন সম্পন্ন করা হয়েছে।
১২ কোটির কাজ, ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা কমিশন লাভ
গতকাল ১৯ অক্টোবর কুমিল্লা সড়ক বিভাগের আওতাধীন চান্দিনা-দেবিদ্বার সড়কের (Z-1008) PMP কাজের জন্য ‘রিমী নির্মাণ লিমিটেড’ (Rimi Nirman Ltd.) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পায়।
প্রকল্পের মোট মূল্য ১২,৮১,৪৬,৯৫৯ টাকা (প্রায় ১২ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা) বিক্রয় কমিশন ২০ শতাংশ কমিশনের অর্থমূল্য প্রায় ২ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা
সরকারি চুক্তির শর্ত কঠোরভাবে মেনে চললে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। কিন্তু সূত্র নিশ্চিত করেছে, রিমী নির্মাণ লিমিটেড এই চুক্তিটি হাতে পাওয়ার পরপরই হাসনাতআব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের কাছে তা বিক্রি করে দেয়া হয়। চুক্তির মূল অর্থের ২০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা সরাসরি কমিশন হিসেবে মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এই অর্থ সরাসরি জনগণের করের টাকা, যা সরকারিঅর্থ লুট এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
NCP প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ নিয়ন্ত্রণ
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এনসিপি প্রভাব ব্যবহার করে হাসনাত আব্দুল্লাহ তার আত্মীয়কে এই লাভজনক চুক্তির নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়েছেন। এই আত্মীয় স্বাভাবিক দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ না নিয়েও শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংযোগের জোরে প্রায় ১৩ কোটি টাকার প্রকল্পের কার্যত মালিক বনে যান।
এ বিষয়ে সড়ক বিভাগের এক অভ্যন্তরীণ সূত্র মন্তব্য করে, “কাজটি কে জিতল তা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যায়। কুমিল্লা দুর্নীতির এই চক্রে রাজনৈতিক নেতার আত্মীয় হওয়ায় তিনি কাজ না করেও কাজের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী।”
বর্তমানে কাগজে-কলমে রিমী নির্মাণ লিমিটেড ঠিকাদার হলেও, বাস্তবে সকল কাজ ও আর্থিক লেনদেনের নিয়ন্ত্রণ এখন তৃতীয় পক্ষের হাতে। এই অবৈধ হস্তান্তরের ফলে মূল ঠিকাদার কোনো পরিশ্রম ছাড়াই ২.৫৬ কোটি টাকা লাভ করল।
কাজের মান নিয়ে শঙ্কা: জনগণের অর্থের অপচয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই কমিশনবাণিজ্য সরাসরি সড়কের গুণগত মানকে প্রভাবিত করবে। যখন কাজের মোট বাজেট থেকে ২০ শতাংশ অর্থ কমিশন হিসেবে বেরিয়ে যায়, তখন প্রকৃত নির্মাণ কাজে ব্যবহার করার জন্য অর্থ কমে যায়। এর ফলে নির্মাণ সামগ্রীর মান (যেমন বিটুমিন, পাথর, কংক্রিট) খারাপ হতে বাধ্য।
প্রকৌশলীরা সতর্ক করেছেন, এই ধরনের নিম্নমানের কাজ হলে সড়কটি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, এবং জনগণের অর্থ আবারও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ এই আর্থিক অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহারের অভিযোগ সত্ত্বেও সওজ কর্তৃপক্ষ নীরব। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে হাসনাতআব্দুল্লাহর প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে কেউই সরাসরি এই অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না।
এই পরিস্থিতিতে, সাধারণ জনগণের দাবি—সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দ্রুত এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এই ক্ষমতারঅপব্যবহার ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরু করা হোক।
Leave a Reply