হাকিকুল ইসলাম খোকন,বাপসনিউজঃঅন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘের চলতি ৮০তম অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে নিউইয়র্কে সরগরম অবস্থা তৈরী হয়েছে। জেএফকেস এয়ারপোর্টে তাকে স্বাগত জানানো এবং প্রতিহত করতে পরস্পর বিরোধী কর্মসূচিতে তটস্থ নিউইয়র্কের পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থাও। এমন অবস্থা দৃশ্যমান হয় ২১ সেপ্টেম্বর রোববার সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসের অলি-গলিতে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের হাজারো নেতা-কর্মীর মধ্যে মারমুখো অবস্থা সামলাতে হিমসিম খায় পুলিশ। তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মধ্যে অঘোষিত একটি বিষয় অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে যে, তারা সহিংস হবেন না। নিজ নিজ বক্তব্য-স্লোগানের বাইরে আক্রমণাত্মক কোন আচরণ না করতেও তারা সচেষ্ট ছিলেন। উল্লেখ্য, এর আগে শেখ হাসিনা জাতিসংঘে আগমনের প্রাক্কালে পরস্পরের প্রতি ইট-পাটকেল, পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটতো। কদিন আগে নিউইয়র্ক কন্স্যুলেটের একটি সভায় তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের যোগদানকালে বাইরে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তোলকালাম কান্ড ঘটিয়েছেন। তেমন উত্তেজনা-অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এবার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা বিশেষ ভ’মিকা পালন করছেন বলে অনেকের ধারণা। তবে জেএফকে এয়ারপোর্টে (স্থানীয় সময় সোমবার বেলা তিনটার দিকে) আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মসূচির জন্যে নিরাপত্তা রক্ষীরা নিরাপদ দূরত্বে দুটি স্থান চিহ্নিত করে রেখেছে বলেও জানা গেছে।খবর আইবিএননিউজ।

এদিকে, বিএনপি, যুবদল দল,শ্রমিক দল, জাসাস, স্বেচ্ছাসেবক দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা ২১ সেপ্টেম্বর অপরাহ্ন থেকেই জ্যাকসন হাইটসে অবস্থান নিয়ে জেএফকে এয়ারপোর্টে মুহম্মদ ইউনূসকে সর্বাত্মকভাবে স্বাগত জানানোর সামগ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে মতবিনিময়ের পর এক র্যালিতে মিলিত হন। ঠিক একইসময়ে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ, স্টেট আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও ইউনূসকে প্রতিহত করার স্লোগান ধরেন। বাংলাদেশী অধ্যুষিত এ বাণিজ্যিক এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পরস্পর-বিরোধী স্লোগানে। খবর পেয়ে পুলিশ অকুস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং পাশাপাশি দূরত্বে স্লোগান চলতে থাকে। এ সময় বিএনপির র্যালি থেকে সকলকে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকার আহবান জানান আন্তর্জাতিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল লতিফ সম্রাট, জিল্লুর রহমান, গিয়াস আহমেদ এবং গোলাম ফারুক শাহীনও এ সময় সকলকে শৃঙ্খলা রক্ষা করে মুহম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘ সফরকে সাফল্যমন্ডিত করার পরিবেশ ধরে রাখার আহবান জানান। উল্লেখ্য, জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আসছেন-এ সংবাদ নিশ্চিত হবার পরই যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি, নিউইয়র্ক স্টেট এবং মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা সরব হয়েছেন এবং ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন জেএফকে এয়ারপোর্টে স্বাগত জানাতে। যুক্তরাষ্ট্র যুবদলের সাবেক সভাপতি জাকির এইচ চৌধুরী এবং সেক্রেটারি আবু সাঈদ, যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা এম এ বাতিন, যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি বাবরউদ্দিন, নিউইয়র্ক স্টেট বিএনপির সভাপতি মাওলানা আতিকুর রহমান, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জসিমউদ্দিন, সেক্রেটারি আবু সাঈদসহ নেতৃবৃন্দ সরব রয়েছেন আওয়ামী লীগের যে কোন অপতৎপরতা রুখে দিতে।

অপরদিকে বাপসনিউজ প্রতিনিধি জানান: জাতিসংঘে মুহম্মদ ইউনূস আসছেন জানার পর থেকেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘যেখানে ইউনূস-সেখানেই প্রতিরোধ’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী গত কদিন থেকেই নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন স্থানে প্রস্তুতি সমাবেশের পর ২১ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকে শতশত নেতা-কর্মী জড়ো হন জ্যাকসন হাইটসে। তারা ব্যাপক বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। জেএফকে এয়ারপোর্টে তুমুল প্রতিবাদের ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দেন নেতৃবৃন্দ। তারা জানান, শান্তিপূর্ণভাবে যতটা সম্ভব প্রতিরোধ রচনা করা হবে। ইতিমধ্যেই এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও জানান নেতৃবৃন্দ। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র উপদেষ্টা ড.প্রদীপ রঞ্জন কর জানান, মুহম্মদ ইউনূসের স্বরুপ আমরা বিশ্ববাসির সামনে উম্মোচনের সকল প্রস্তুতি নিয়েছি। ম্যানহাটানে যে হোটেলে তিনি অবস্থান করবেন সেখানে প্রতিদিনই অপরাহ্নে র্যালি হবে। গত এক বছরের ‘অপশাসন’র ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হবে। জাতিসংঘে ইউনূসের ভাষণের সময় বাইরে হাজার প্রবাসীর সমাগমের অনুমতি নেয়া হয়েছে। নিউইয়র্ক কন্সুলেটের ব্যবস্থাপনায় মুহম্মদ ইউনূসকে সম্বর্ধনার যে আয়োজন ২৭ সেপ্টেম্বর করা হবে সেখানেও শতশত প্রবাসী বিক্ষোভ দেখাবেন বলে জানান আওয়ামী লীগের এই নেতা। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, বহুবছর যাবত যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছি, রাজনীতির সাথে জড়িত। কিন্তু আগে কখনো কোন কন্সাল জেনারেলকে প্রবাসীদের বিরুদ্ধে সরাসরি মিথ্যাচার-মাস্তানীতে পরিণত হতে দেখিনি। বর্তমানের কন্সাল জেনারেলের অক’টনৈতিক আচরণ সকলকে ক্ষেপিয়ে তোলেছে যার শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
মুহম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশ নিতে ওয়াশিংটন,ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, টেক্সাস, মিশিগান, ইলিনয়, বস্টন, ভার্জিনিয়া, ম্যারিল্যান্ড, পেনসিলভেনিয়া, নিউজার্সি, কানেকটিকাট এবং কানাডা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও নিউইয়র্কে এসেছেন বলে জানালেন আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সিনিয়র সাংবাদিক হাকিকুল ইসলাম খোকন,মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, এডভোকেট শাহ মোঃবখতিয়ার,এমএ করিম জাহাংগীরসহ নেতৃবৃন্দ জেএফকে এয়ারপোর্টে বিক্ষোভ-সমাবেশের সার্বিক সমন্বয় করছেন বলে সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে।
এদিকে, জেএফকে এয়ারপোর্টে মুহম্মদ ইউনূসকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি তুমুল বিক্ষোভের কর্মসূচি জেনে এয়ারপোর্ট প্রশাসন নিরাপত্তার বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সকলকে তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনে সহায়তা দেবেন। তবে কেউ উচ্ছৃঙ্খল হলে শাস্তির আওতায় নেয়ার হুশিয়ারিও দেয়া হয়েছে।
এদিকে জানা গেছে, সফরসূচি অনুযায়ী, অধ্যাপক ইউনূস ২৬ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। এছাড়া তিনি একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। ভাষণে তিনি বিগত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারমূলক উদ্যোগ, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা এবং ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার তুলে ধরবেন। সফরসঙ্গী হিসেবে ছয়জন রাজনৈতিক নেতা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রয়েছেন। তারা হলেন: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামী নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ও জামায়াত নেতা নকিবুর রহমান তারেক এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা।
বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, এ বছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির সভাপতিত্বে ‘হাই লেভেল কনফারেন্স অন দ্য সিচুয়েশন অব রোহিঙ্গা মুসলিম অ্যান্ড আদার মাইনোরিটিস ইন মিয়ানমার’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এটি জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রথমবারের মতো এমন একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক বলে দাবি করা হচ্ছে। এই বৈঠক থেকে কার্যকর সমাধান উদ্ভাবনের জন্য গত মাসে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক অংশীদার ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অধ্যাপক ইউনূসের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে, যা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন পেয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ২৫ সেপ্টেম্বর যুবকদের জন্য কর্মপরিকল্পনার ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেবেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরবেন। ভাষণে তিনি শান্তিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন, নিরাপদ অভিবাসন, অবৈধ অর্থপাচার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো বিষয়ও তুলে ধরবেন। সফরকালে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এবং বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও কমনওয়েলথ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভা, পিসবিল্ডিং কমিশন মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠক, ‘জি-৭৭ ও চীন’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক, নারী-শান্তি ও নিরাপত্তা ফোকাল পয়েন্ট নেটওয়ার্ক, ওআইসি বার্ষিক সমন্বয় সভা, বিমসটেক, সিকা এবং এলডিসি মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
Leave a Reply