লেখা- মোঃ আবু মুসা আসারি
ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ও সাহিত্যপ্রেমী
musasirajofficial@gmail.com
একটি সিনেমা কেবল গল্প বলার মাধ্যম নয়, বরং সে হতে পারে একটি সময়ের প্রতিবিম্ব, হতে পারে প্রশ্ন তোলার এক সাহসী ভাষা। বাংলা চলচ্চিত্রে এমন প্রজ্ঞাবান সাহসিকতার এক অমর উদাহরণ “হীরক রাজার দেশে”—সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত এমন এক ব্যতিক্রমী রূপকথা, যা শিশুদের হাসায়, আর বড়দের ভাবায়। হাস্যরস, ছড়ার ছন্দ, আর কল্পনার চাদরে মোড়া এই চলচ্চিত্র আসলে শাসনব্যবস্থা, চিন্তার স্বাধীনতা ও শিক্ষার বিকৃতি নিয়ে এক বিদ্রুপের অজেয় দলিল।
‘হীরক রাজার দেশ’—এই কাল্পনিক ভূমি আদতে কোনো দূরদেশের গল্প নয়; বরং যে সমাজে আমরা বাস করি, তারই ছায়াপ্রতিচ্ছবি। যেখানে সত্য বলার অধিকার নেই, সৃজনশীলতা চাপা পড়ে ভয় আর শাসনের ভারে, এবং মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখানো হয় না—সেই দেশই হীরক রাজার দেশ। রাজা, যিনি নিজেকে দেবতা মনে করেন, তার চারপাশ ঘিরে থাকে চাটুকারের দল। এমন এক দেশে গান হারিয়ে যায়, কবি হয়ে ওঠে নির্বাক, আর শিক্ষাকে ব্যবহার করা হয় দাসত্ব শেখানোর হাতিয়ার হিসেবে।
এই নিস্তব্ধতার মাঝেই দাঁড়িয়ে থাকেন এক উদয়ন পণ্ডিত। কাঁধে দায়িত্ব—চোখে বিদ্রোহ। তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন বিদ্রোহের প্রথম পাঠশালা। তিনি শেখান, “ভালো করে ভাবো, প্রশ্ন করো, বুঝে নাও।” তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত একটি লাইন—
“যত গণি তত জানি, যত জানি তত ভাবি…”
শুধু ছড়া নয়, এক বিপ্লবের দর্শন। তিনি যেন সত্যজিতের নিজের স্বর, যিনি চেয়েছিলেন বুদ্ধিমত্তাকে ছড়িয়ে দিতে, ভয় না পেয়ে কথা বলতে শেখাতে।
ছবির প্রতিটি চরিত্র একেকটি সমাজ বাস্তবতার প্রতীক। রাজা প্রতিকৃতি ক্ষমতালোভী শাসকের, যার প্রধান পুঁজি ভয় আর মিথ্যা প্রচার। তার মন্ত্রীরা হচ্ছে সুযোগসন্ধানী চাটুকার। কবি চরিত্রটি দেখায় সৃজনশীলতা কীভাবে দমিয়ে দেওয়া হয়। আর সেই ভাঁড়—চুপচাপ, হাস্যরসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদ—সে কারো পক্ষ নেয় না, কিন্তু সত্যটাকে দেখে ফেলে।
এই সিনেমার গানগুলো শুধুই শিশুদের বিনোদনের উপকরণ নয়। এগুলো প্রতিটি একটি করে প্রতিবাদের সুর।
“এক যে ছিল রাজা, বুদ্ধি ছিল না তার”—এটি নিছক একটি ছড়া নয়, বরং অন্ধ ক্ষমতার করুণ চিত্র।
“সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, মুখে যদি কেউ বলে সত্যি কথা”—এই একটি লাইন একাধিক শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
রায় তাঁর লেখনীতে কাব্যিকতা আর রসবোধের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে এমনভাবে জড়িয়েছেন যে, তা দর্শককে অবচেতনেও ভাবাতে বাধ্য করে।
সত্যজিৎ রায়ের জাদু এখানেই—তিনি এমন এক জগত নির্মাণ করেছেন, যা চাক্ষুষভাবে সরল, কিন্তু ভেতরে তীক্ষ্ণ। তাঁর ক্যামেরা সাবলীল, রঙের ব্যবহার চিন্তাভাবনা-সম্মত, প্রতিটি সেট ডিজাইন প্রতীকী ব্যঞ্জনায় পূর্ণ। ‘জন্তার মন্ত্রা’ নামক মেশিনটি যেমন কল্পনা থেকে উঠে আসা, তেমনই বাস্তব রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিচ্ছবি—যেখানে মানুষকে ভীত, ভ্রান্ত, এবং নির্বোধ করে রাখা হয়।
চার দশক পেরিয়ে গেলেও, ‘হীরক রাজার দেশে’ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। কারণ প্রতিদিন আমাদের চারপাশে জন্ম নেয় ছোট ছোট হীরক রাজ্য, যেখানে সত্য চাপা পড়ে, স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। আমরা দেখেছি কীভাবে মত প্রকাশে বাধা আসে, কীভাবে শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়, কীভাবে মিডিয়া হয়ে ওঠে রাজা-ভজনার যন্ত্র।
এই সিনেমা আবার স্মরণ করিয়ে দেয়—যদি অন্ধ আনুগত্য প্রশ্নকে গ্রাস করে নেয়, তবে তন্দ্রা থেকে জাগাতে হবে মানুষকে। শিশুদের হাসির ছলে শোনানো এই গল্প, পরিণতদের জাগাতে পারে এক ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে।
‘হীরক রাজার দেশে’ শুধুই রূপকথা নয়, এটি এক শাণিত প্রতিক্রিয়া। এটি এমন এক চলচ্চিত্র যা কখনো মুছে যাবে না, বরং যতবারই তা দেখা হবে, ততবারই নতুন কোনো উপলব্ধি জাগাবে। সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন, শিশুর ভাষায়ও বলা যায় বড় কথা। আর সেই কথার প্রভাব এত গভীর যে, একসময় তারা নিজেই হয়ে ওঠে পরিবর্তনের হাতিয়ার।
হীরক রাজার দেশে আজও আমাদের বলে—
👉 শাসক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, চিন্তাশীল একদল মানুষই পারে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে।
Leave a Reply